নৈসর্গিক নান্দনিকতায় বৃক্ষরাজি

TopicSnap
0

 

নৈসর্গিক নান্দনিকতায় বৃক্ষরাজি




অন্ধ ভূমি গর্ভ হতে শুনেছিলে সূর্যের আহবান

প্রাণের প্রথম জাগরণে, তুমি বৃক্ষ, আদি প্রাণ....

প্রায় দশ কোটি বছর পূর্বে সপুষ্পক উদ্ভিদ গোত্র ধরিত্রীকে পুষ্প পল্লবে সুশোভিত করেছিল প্রাণিকুলের আবির্ভাবকে সুস্বাগতম জানাতে। আদিতে মানুষ ছি যাযাবর, ফলজীবী অরণ্যবাসী ও বৃক্ষশ্রয়ী। উর্বর  ‍মৃত্তিকা আর পর্যাপ্ত সুপেয় পানির নিশ্চিত  প্রাপ্তি তাকে উদ্বুদ্ধ করে বসতি স্থপনে। সূচিত হয় কৃষি তথা বৃক্ষ রোপণের যুগ। শুরু হতেই মানব জীবন সর্বাংশে উদ্ভিদ বেষ্টিত। আস্তিকগণের বিশ্বাসের গভীরতায় যে স্বর্গের ছবি স্ফটিকের ন্যায় স্বচ্ছ সেই স্বর্গদ্যানেও প্রকৃতির অলষ্কার সবুজ ঘাসের গালিচা, লতা গুল্মো সুশোভিত, পুষ্পপল্লবে দৃষ্টিনন্দন, গিরিকন্যা ঝরণার বয়ে চলার ছন্দে ছন্দে অকৃত্রিম সৌন্দর্যে নয়নাভিরাম। আমাদের আদি পিতা-মাতা নিষিদ্ধ প্রজাতির ফল ভক্ষণের অপরাধে যখন মর্ত্যে পতিত হন তখন পরম যত্নে আশ্রয় পেয়েছিলেন ভিন্ন প্রজাতির বৃক্ষের কাছেই, ফলবান বৃক্ষরাজি তাদের ক্ষুন্নিবৃত্ত করেছিল অপার মমতায়। সেই থেকেই মানবসহ সকল প্রাণীকে সযত্নে লালন করছে ফল ফুল ছায়াবীথি প্রসারিত করে, আর ধরিত্রী ধারণ করছে তার সন্তান, উদ্ভিদ ও প্রাণিকুলকে অকুপণ ঔদার্যে। ভিন্ন ধর্মীয় বিশ্বাসের অনুসারীগণের পূঁজা অর্চনায়, স্তব-স্তুতি, সাধনা আরাধনায়ও বৃক্ষ একটি অভিন্ন অনুযঙ্গ। বৃক্ষ ধৈর্যের প্রতীক, ধীরস্থির সাধনার প্রতীক, জীবনের সার্থকতার প্রতীক। শান্তি, সহিষ্ণুতা আর প্রশান্তির যে নিরব অভিব্যক্তি তা মানুষের জন্য শিক্ষার দ্বার উন্মোচিত করে। অঙ্গার বাতাসে মিশে থাকে, বৃক্ষ তা নিগুঢ় শক্তি বলে শোষণ করে নিজের করে লয়। এছাড়াও প্রাকৃতিক সৌন্দর্যমন্ডিত, ছায়াবীথি গড়ে উঠে। বিশ্বব্যাপী মানুষের আচার অনুষ্ঠান, আনন্দ বেদনায়, শোকে দুঃখে পবিত্রতার প্রতীক হিসেবে  ব্যবহৃত হচ্চে যে জানা-অজানা নামের অসংখ্য ফুল তা প্রকৃতির অপার বিস্ময়কর সুন্দর, সুশোভিত, দৃষ্টি নন্দন, উপহার। এদেশে জন্মদিন, গায়ে হলুদ, বিয়ে, বাসরশয্যা, বর্ষ বরণের মত আনন্দঘন অনুষ্ঠানের পাশাপাশি জাতীয় বীরদের মরদেহকে বরণ করি, তাদের সমাধি এমন কি  স্মৃতিসৌধে অন্তরের অর্ঘ্যে আর শ্রদ্ধার সাথে পুষ্প স্তবকের অঞ্জলি দিয়ে। ফুলের সৌন্দর্য তাই অবাধ শিশু থেকে সুগভীর আধ্যাত্মিক চেতনায় আপ্লুত ক্ষণজন্মা মানবকুল শ্রেষ্ঠ ব্যক্তিকেও আকুষ্ট করেছে আপন রূপ-রস গন্ধে। ত্যাগের মহামূল্য মহিমায় সমুজ্জল হৃদয় হতে উচ্চারিত হয়েছে “যদি জোটে মোটে একটি পয়সা খাদ্য কিনে নিও......অনুরাগী”। বিদ্যান, বিনয়ী ব্যক্তিকে ফলবান বৃক্ষের সঙ্গে তুলনা করে বলা হয়েছে “ফলেরভারে বৃক্ষশাখা নত, বিদ্যারভারে বিদ্যান বিনয়ী”। মানুষের আবেগ, উচ্ছ্বাস বেদনায় বৃক্ষের অবস্থান সুদৃঢ়।




চিরাচরিত ভেষজ চিকিৎসা ছাড়া বৃক্ষকে আলিঙ্গন করেও মানুষের দূরারোগ্য ব্যাধি নিরাময় হয় আন্তরিক অনুভূতি ও পরম বিশ্বাসের অনুবন্ধের মাধ্যমে বৃক্ষ মানুষের জটিল ব্যাধি নিচে গ্রহণ করে তাকে নিরাময় করে। একটি কদম্ব গাছকে নিয়মিত আলিঙ্গন করে একজন বয়স্ক লোক কিভাবে আরোগ্য লাভ করলেন তা যু্ক্তিগ্রাহ্য অথচ সুখপাঠ্য বর্ণনা দিয়েছেন প্রথিতযশা বিজ্ঞানী ডঃ নওয়াজেশ আহমদ “মহীরুহ শ্রন্থন” প্রবন্ধে। বৃক্ষ ইতিহাস ঐতিহ্যেরও ধারক। পলাশীর আম্রকাননে বাংলার স্বাধীনতার অস্তমিত সূর্য নতুন করে উদিত হোল মুজিবনগর আম্রকাননেই। মহাগ্রন্থ কুরআনে লতাগুল্ম-বৃক্ষরাজিকে বিশ্ব স্রষ্টার মহান অনুগ্রহ বলে উল্লেখ করা হয়েছে এবং তার মধ্যে বিশ্বাসীদের জন্য চিন্তার খোরাক বিদ্যমান রয়েছে। ইসলাম ধর্মের মর্মবাণী অনুসারে মৃত্যুর পর মানুষের পুণ্য অর্জনের পথ রুদ্ধ হয়ে যায়। পুণ্য সঞ্চয় অব্যাহত রাখার অন্যতম ব্যবস্থা হলো জীবিতকালে বৃক্ষ রোপণ করা। বৃক্ষের ফল, ছায়া, পাখির আশ্রম পুণ্য অর্জনের উৎস হিসেবে পরিগণিত হয়। ইসলামের প্রবর্তক মানবকুল শ্রেষ্ঠ হযরত মোহাম্মদ (সঃ) নিজ হাতে বৃক্ষ রোপণ করেছেন, বিশেষ করে ফল বৃক্ষ এর্ব তাঁর প্রিয় অনুসারীদেরও বৃক্ষ রোপণের জন্য তাগিদ দিয়েছেন। তাঁর বাণীতে (হাদীস) উল্লেখ রয়েছে “যখন কোন মুসলমান একটি চার গাছ রোপণ করে এবং কোন মানুষ অথবা পশুপাখি খায় কিংবা কেউ চুরিও করে তাহলে সেই রোপণকারী সদকার সওয়াব পাবে। “অন্যত্র উল্লেখিত আছে” আপনি যদি নিশ্চিত থাকেন যে আগামীকাল কেয়ামত হবে, আপনি তবু আজকেই একটি গাছ লাগান। “গৌতম বুদ্ধ যে কোন বৃক্ষ” তলায় বসে সাধনার মাধ্যমে সিদ্ধি লাভ করেছিলেন বাস্তবে সেটি ছিল প্রাচীন অশ্বর্থ গাছ। সনাতন ধর্মের বিভিন্ন গ্রন্থ রামায়ন, মহাভারত,  বেদ ও শ্রীগৎভগবত গীতায় বারংবার ছত্রে ছত্রে যথাযথভাবে বৃক্ষরাজির উল্লেখ করা হয়েছে অনিবার্য প্রসঙ্গ হিসেবেই। পুরাকালের সাধু সন্ন্যাসীদের সাধনা, তপস্যা, প্রাপ্তি সবই ছিল অরণ্যমুখী, বনকেন্দ্রিক। নৈমিযা অরণ্যে একদা ৬০ হাজার সাধুর বাস ছিল বলে জানা যায়। প্রাচীন ভারতে বৃক্ষ পূঁজার বহুল প্রচলন ছিল। এক গাছের পুষ্প মঞ্জুরি ও ফল দিয়ে অন্য গাছকে পূঁজা করা হতো। পবিত্র মনে করে বৃক্ষকে লালন করা হতো। অতি উপকারী ভেষজ গুণের আধার তুলসী গাছ যেমন আজও সযত্নে লালিত হয় সনাতন ধর্মাবলম্বীদের দ্বারা।

বৃক্ষের অবদান।

উদ্ভিদ বিজ্ঞানীদের বিচার বিশ্লেষণে আড়াই লক্ষ জাতের সত্যিকার সপুষ্পক এবং পঞ্চাশ হাজার জাতের অপুষ্পক বৃক্ষলতার নামকরণ করা হয়েছে। তাদরে অনেকেরই রয়েছে শত সহস্র প্রজাতি। সব মিলিয়ে লতাগুল্ম, বৃক্ষরাজির এক সুবিশাল। বিস্ময়কর জগত জলে ও স্থলে সমভাবে বিস্তৃত। সৃষ্টির সেরা জীব পরাক্রমশালী মানুষসহ প্রাণিকুলের অন্যান্য নিজস্ব খাদ্য তৈরি করতে কোন মৌলিক পদার্থ সৃষ্টি করতে পারে না। শুধুমাত্র আংশিক রূপান্তরের মাধ্যমে নিজ প্রয়োজনের উপযোগী করে তুলতে পারে। পৃথিবীর সমস্ত শক্তির উৎস চির উজ্জ্বল আগুনের পিন্ড সূর্য। নির্বাক অচল বৃক্ষরাজি, লতাগুল্ম আন্তর্নিহিত শক্তির বলে সূর্য থেকে তাপশক্তি নিয়ে নিজ দেহের মূল, কান্ড, পাতা, ফুল ও ফলে খাদ্যরূপে জমিয়ে রাখে, যার উপর প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে প্রাণিকূল আজীবন সর্বাংশে নির্ভরশীল। বেশ কিছু সংখ্যক গাছের ফল বীজ আমাদের প্রধান খাদ্য হিসেবে বিবেচিত হয় যেগুলো অধিকাংশ বর্ষজীবী। সুস্বাদু তৃপ্তিকর পানীয় তৈরিতে ব্যবহৃত হয় গাছের পাতা বা বীজ, কাঠ দগ্ধ হয়ে কয়লায় পরিণত হয় আমাদের রসনা তৃপ্তিকর উপাদেয় খাবার তৈরিতে। আভিজাত্যের পোশাক থেকে অতিসাধারণ পোশাকের যোগান দেয় বৃক্ষ। বাসগৃহ, উপাসনালয় থেকে রাজপ্রাসাদের সৌন্দর্য আর ঐহিত্য ধারণ করে বৃক্ষ তার জীবনাবসান করে। আমাদের অভিজাত আসবাবপত্র থেকে সাধারণ ব্যবহার্য নিত্য প্রয়োজনীয় সবই বৃক্ষজাত। সভ্যতার মাইলফলক কাগজ ও চাকা উৎপাদনের প্রাথমিক উপাদান বৃক্ষ। প্রাচীনকাল থেকে মানুষের জরাব্যাধির নিরাময়ক হিসেবে ভেষজ গাছ-গাছড়ার ব্যবহার সর্বজনবিধিত। এ উপমহাদেশের করিাজী, ইউনানী ও আয়ুর্বেদিক চিকিৎসায় বিভিন্ন প্রকার লতাগুল্মের ব্যবহার বৈদিক যুগ হতে চলে আসছে। যার হৃত এশীয় ঐতিহ্য নতুন করে ধারণের প্রয়াস পাচ্ছে ইউরোপীয়গণ অথচ বিংশ শতকের প্রথমে প্রকাশিত বিভিন্ন ভারতীয় গ্রন্থে সহস্রাধিক বৃক্ষলতার ভেষজ গুণ ও তার ব্যবহারবিধি সবিস্তারে লিপিবদ্ধ রয়েছে। বর্তমানে তরুলতা, বৃক্ষরাজি থেকে দশ সহস্রাধিক দ্রব্য সামগ্রী তৈরি হচ্ছে যা প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে আমাদের নিত্যদিনের প্রয়োজন মেটাচ্ছে। নবজাতককে  মিষ্টভাষী হিসেবে গড়ে তোলার আকাঙ্ক্ষায় জন্মলগ্নে মুখে যে মধু দেয়া হয় তা ফুলের নির্যাস বৈ কিছু নয়। অপরপক্ষে, শবযাত্রার “পালকি” টিও দান করে একটি গাছ তার জীবন সংহার করে। সাহারার দ্বার ঘেঁষে গাছ লাগিয়ে মরুকরণ হ্রাস করা হচ্ছে। অনুরূপভাবে চীন প্রাচীর গায়ে, রাশিয়া, কাজাক্স্তিান, ইসরাইল বৃক্ষ রোপণের মাধ্যমে মরুকরণ হ্রাস করছে। জাপানীরা মৃত্তিকা ক্ষয় রোধ, সুইজারল্যান্ডে হিমবাহের প্রকোপ কামাচ্ছে। বৃক্ষগুল্মের পুষ্প পল্লবের সৌন্দর্য নিয়ে এত যে উপমা তাতেও বৃক্ষরাজির অবদান অনস্বাীকার্য। বৃক্ষের অসামান্য অবদানকে অন্তরের গভীরে সামগ্রিকভাবে ধারণ করে হৃদয় নিঃসৃত স্বতঃস্ফূর্ত উপলব্ধিজনিত স্বকীয় বৈশিষ্ট্যে, ছন্দে, লালিত্যে স্বার্থকভাবে প্রকাশের দাবীদার এদশের অগণিত বৃক্ষপ্রেমী কবি, সাহিত্যিক। তাদের মধ্যে রয়েছেন বাংলা সাহিত্যের মহীরুহ কবিগুরু, মধুকবি, কান্ত কবি, রূপসী বাংলা কবি, পল্লীকবিসহ দেশের প্রদান কবি এমনকি বিদ্রোহী কবি যার বিদ্রোহী মনও বৃক্ষে প্রিয়ার অপরূপ রূপের বর্ণিল বর্ণনায় অনিন্দ্য মধুর কাব্য রচনা করেছেন। মানবত্ব আরোপিত গুবাকতরুর হৃদয়ের বাণী শুনেছেন হৃদয়ের অনুভবে।

অধুনা মানুষ নির্বোধের মত বৃক্ষ নিধন করে নিজের অজান্তে পৃথিবীকে পরিণত করছে জতুগৃহে। তাই সাম্প্রতিককালে সিংহভাগ লেখায় ধ্বনিত হচ্ছে বৃক্ষ নিধনের শষ্কায় শষ্কিত কবি মনের অস্থিরতার বহিঃপ্রকাশ। বৃক্ষের নিঃসর্গ নন্দনে অসামান্য অবদানের কথা “বৃক্ষ মঙ্গল” এর কবি ব্যক্ত করেছেন “ও অরণ্যা! জ্যোৎস্নাস্নাত রাত্রির প্রতীমা/রাশি রাশি পাতার মখমলে আমাকে আবৃত কর। পোড়া পিঠে মেখে দাও মমতার সবুজ ভেষজ ধুয়ে যাক দীর্ঘশ্বাসগুলো।” নগরবাসী মানুষের জন্মান্তরের সখা বৃক্ষের প্রতি আক্রমণাত্মক দৃষ্টিভঙ্গির বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছেন লক্ষ কোটি বৃক্ষপ্রমীর প্রতিনিধি হয়ে “বৃক্ষ মানুষ” এর কবি তার দৃপ্ত কান্ঠে “মানুষ তুমি গাছের পক্ষে দাঁড়াও /মানুষ তুমি বৃক্ষমুখী হও/ গভীর নিঃসর্গ তোমাকে অভিবাদন জানাবে আর অভিবাদন কুড়াতে কুড়াতে/মানুষ তুমি আবার মানুষ হবে।

Read More




Tags:

Post a Comment

0Comments

Post a Comment (0)